Upcoming activities:
23rd SCAC: Fourth Industrial Revolution and Future Society (26-28, Oct'24)

Recent activities
On-Spot Project Review (BAS-USDA 6th Phase)- Jun'24

 

বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড


বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড

বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড

তিনি যখন হাসপাতালে রাউন্ডে যেতেন, তখন তার ছাত্রদের কাছ থেকে অন্তত একটি নতুন কিছু শিখতে

সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক আ ফ ম রুহুল হক স্যারকে একবার বলতে শুনেছিলাম, তিনি যখন হাসপাতালে রাউন্ডে যেতেন, তখন তার ছাত্রদের কাছ থেকে অন্তত একটি নতুন কিছু শিখতে না পারলে, জানতে না পারলে তার মনে হতো সেদিনের রাউন্ডটিই বৃথা গেল। কথাটি দারুণভাবে মাথায় গেঁথে আছে শোনার পর থেকেই। আমিও আমার রাউন্ডগুলোতে প্রায়ই ছাত্রদের এই কথাটি বলি। আর যেদিন রাউন্ডে নতুন কিছু না শিখে রাউন্ড শেষ করি, প্রতিবারই মনে হয় রাউন্ডটি আসলেই বৃথা গেল।

তবে ১৩তম বাংলাদেশ সায়েন্স অলিম্পিয়াডটি যে আমাদের জন্য এত বেশি শিক্ষণীয় হবে তা নিয়ে ছিটেফোঁটা ধারণাও ছিল না। আর থাকবেই বা কেন? অলিম্পিয়াডটির প্রতিযোগীরা তো সবাই মাধ্যমিক আর উচ্চ মাধ্যমিক পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রী। উপজেলা পর্যায় থেকে শুরু করে জেলা আর বিভাগীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে সারাদেশ থেকে তাদের যতই বাছাই করে আনা হোক না কেন, আমার কাছে তারা তো ছাত্রদেরও ছাত্রতুল্য।

কাজেই যখন আয়োজক সংস্থা বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস থেকে দাওয়াত এলো বাছাই করা আগামীর বিজ্ঞানীদের বিজ্ঞান জিজ্ঞাসার উত্তর দিতে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কার্জন হলে উপস্থিত থাকার জন্য, আগ-পিছ, সাত-পাঁচ না ভেবেই তাতে সম্মতি দিয়েছিলাম। তাছাড়া বিজ্ঞান একাডেমির নির্বাচিত ফেলো বলে কথা! বাংলাদেশের সেরা বিজ্ঞানীদের মধ্য থেকে বাছাই করাদের মধ্যে অন্যতম। কাজেই আমি কি ডরাই এসব ছানা-পোনা বিজ্ঞানীদের বিজ্ঞান জিজ্ঞাসায়?
ভুলটা ভাঙতে সময় লাগল অবশ্য কয়েক সেকেন্ড মাত্র। আনুষ্ঠানিক পরিচয় পর্ব শেষে আনুষ্ঠানিকতার শুরুতেই আমি ক্লিন বোল্ড। প্রথম প্রশ্নটি ছিল বিগ ব্যাং সংক্রান্ত। আর এর পরের প্রশ্নটি তো যাকে বলে গুগলি। প্রথম প্রশ্নটি পদার্থবিদ্যার বলে কোনোমতে পাস কাটাতে পারলেও এবারে সেই সুযোগটি নেই। স্কুল পড়ুয়ার প্রশ্ন হচ্ছে, পৃথিবীর বাদ-বাকি বানরগুলো মানুষে বিবর্তিত হবে কিনা এবং হলে তা কবে? এরপর একের পর এক গুগলি, চায়না ম্যান আর ইয়র্কার সামলাতে আমার যাকে বলে আক্ষরিক অর্থেই ঘাম ঝরার জোগাড়।

কেউ জানতে চাচ্ছে, দুজন আইডেন্টিক্যাল টুইনের মধ্যে কে বড় আর কে ছোট, তা কিভাবে নির্ধারণ করা যায়? কারও প্রশ্ন, লিভার যদি ট্রান্সপ্লান্ট করা যায়, তবে কেন ব্রেন নয়? কেউ যখন জানতে চাচ্ছে গর্ভাবস্থায় কেন মহিলাদের ঋতু¯্রাব বন্ধ থাকে? তো তখন আরেকজনের প্রশ্ন, তাকে যদি ক্লোন করা হয়, তবে তার ক্লোনের সঙ্গে তার বয়সের পার্থক্যটা কত হবে? একজন যখন জানতে চাইছে সামনে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স কি মানুষকে ডমিনেট করবে কিনা, তখন অন্য আরেকজনের প্রশ্নের বিষয়বস্তু রোবটিক সার্জারি।

প্রশ্নকারীরা যে শুধু স্কুল-কলেজ পড়ুয়া তা-ই নয়, আছে মাদ্রাসা পড়ুয়ারাও। আর সবচেয়ে বড় কথা, বেশির ভাগ প্রশ্নই আসছে মফস্বলের স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে। অলিম্পিয়াডটিতে পদকপ্রাপ্তদের তালিকাতেও মফস্বলের প্রতিযোগীদেরই জয়জয়কার আর একই সঙ্গে জয়জয়কার মেয়েদের। অনুষ্ঠান শেষে গাড়িতে চেপে যখন চেম্বারমুখী জ্যাম ঠেলছি, দেরিতে চেম্বার শুরু করা কিংবা জ্যামে জর্জরিত হওয়া নিয়ে মনে তখন এতটুকুও বিরক্তি বা খেদ নেই।

বরং সেখানে শুধুই প্রশান্তি। কারণ, আজ আমি শিখেছি অনেক। শিখেছি ঢাকা কেন্দ্রিক আমরা সুশীলরা কত বেশি সমাজ বিচ্ছিন্ন। সুশীলদের অনেককে ইনিয়ে-বিনিয়ে কারিকুলাম পরিবর্তনে কু-বাতাসে হাওয়া দিতে দেখেছি। একদল মানুষ যখন দেশটাকে পিছিয়ে নিতে কোমর কষে নেমেছে, তখন তার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ যৌক্তিকতা খুঁজে পেতে দেখেছি আমাদের অনেককেই। শেষমেশ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডও বাধ্য হয়েছে পঁচিশ কোটি টাকা খরচ করে ছাপানো দুটো পাঠ্যপুস্তক পাঠ্যতালিকা থেকে ছেঁটে ফেলতে।

অথচ আমাদের ধারণাও নেই যে, আমাদের ছেলে-মেয়েরা কতটা এগিয়েছে আর কত বেশি জেনে গেছে। আমাকে বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডের মঞ্চে বসে সেদিন যে প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করতে হয়েছে, হিসাব করে দেখেছি তার কমপক্ষে চল্লিশ শতাংশ বিবর্তনবাদ সংক্রান্ত আর কমপক্ষে পনেরো শতাংশ প্রশ্ন হচ্ছে হিউম্যান রিপ্রোডাকশন রিলেটেড।
পাশাপাশি মনটা আনন্দেও ভরে গেছে। আরও অনেক সমাজ বিচ্ছিন্ন সুশীলের মতোই আমিও হালে বিশ^াস করতে শুরু করেছিলাম যে, কোভিডের সময় পাবলিক পরীক্ষাগুলোর সংকোচন আর সঙ্গে ছোট শ্রেণিগুলোতে পরীক্ষা তুলে দিয়ে আর ঘনঘন পাঠ্যক্রমে পরিবর্তন এনে সরকার সম্ভবত শিক্ষাব্যবস্থাকে শিকেতেই তোলার পাকাপাকি বন্দোবস্ত করছে।

জুনিয়র আর সিনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা আর পাশাপাশি স্টার মার্ক আর স্ট্যান্ডের জামানার এই আমি যদি হাল জামানার এসব হালহকিকতে একটু ভুল বুঝেও থাকি, তা বোধ করি ক্ষমাসুন্দরভাবে দেখা যেতেই পারে। বিশেষ করে যখন পত্রিকায় লিখে অকপটে আমার বোঝার ভুলটুকু স্বীকার করে নিচ্ছি। তবে লেখাটার আরও একটা উদ্দেশ্য আছে। আর তা হলো প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দেওয়া- দেশের শিক্ষাটাকে ঠিকমতো এগিয়ে নেওয়ার জন্য। সঙ্গে শিক্ষামন্ত্রীরও একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য।

সঙ্গে অবশ্য এও বলতে চাই, যে যাই বলুক না কেন, আমরা নিশ্চিত দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখন সেই শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়েছে। আমি যখন একজন স্কুল পড়ুয়ার প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলাম যে, ‘ধর্ম আমার বিশ^াস, তবে বিজ্ঞানকে আমি প্রমাণ ছাড়া গ্রহণ করব না। আর যারা ধর্মকে প্রমাণ করাতে চায়, তারা আসলে আমাদের ফিরিয়ে নিতে চায় অন্ধকারের জামানায়’Ñ তখন স্টেজে আমার সামনে বসে থাকা পাঁচ শতাধিক আগামীর বাংলাদেশের কারও মুখে সংশয়ের লেশমাত্র দেখিনি।

লেখক : ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয় ও  সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ

Published in Daily Janakantha on 18 February 2023: [News Link]